করমপূজা বনবাসী সমাজের এক অন্যতম উৎসব, যা মূলত প্রকৃতি ও বনের মধ্যে সমন্বয়ের একটি ভাবনা তুলে ধরে। এই উৎসবটি কৃষি ও প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং বনের সম্পদের গুরুত্ব বোঝাতে একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। করমপূজা মূলত এক ধরনের গাছের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন, যাকে এই সমাজে ‘করম’ বলে অভিহিত করা হয়। তবে বাংলায় এটি পরিচিত ‘কেলী-কদম’ নামে। সংস্কৃত সাহিত্যে গাছটির পরিচিতি ‘গিরিকদম্ব’ নামে পাওয়া যায়, যার মানে হলো ভারতের মালভূমির অনুচ্চ পাহাড়ে পর্ণমোচী গাছের এক প্রজাতি, যেটি মূলত কদম ফুলের এক বিশেষ প্রজাতি।
সূচিপত্র
করম পূজা কি
এছাড়া অসমিয়া ভাষায় গাছটির নাম ‘তারকচাঁপা’, এবং এর হলুদ রঙের কারণে গাছটিকে আদর করে ‘হলদু’ নামেও ডাকা হয়। ইংরেজি ভাষায় এর নাম হলুদ সেগুন বা Yellow Teak এবং গেরুয়া সেগুন বা Saffron Teak হিসেবে পরিচিত। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে গাছটির নাম Adina cordifolia (Roxb.) Hook. f. Ex Brandis, অথবা Haldina cordifolia (Roxb.) Ridsdale।
এটি রুবিয়েসী গোত্রের একটি গাছ, যেটি কফিগাছ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। গাছটি প্রায় ২০ মিটার উচ্চতায় বেড়ে ওঠে এবং জুন থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত সুন্দর হলুদ ফুল ফুটে। এই গাছটি ভারতের পর্ণমোচী অরণ্যের একটি অনন্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত, এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এর আদিনিবাস। ভারত ছাড়াও মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, নেপাল, ভূটান, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ চীন, ভিয়েতনাম, এবং মালয়েশিয়া সহ বিভিন্ন দেশে এই গাছটির বিস্তার দেখা যায়।
গাছটির বৈশিষ্ট্য
গাছটির ছালের রঙ হাল্কা বাদামী, এবং এর ছালের পৃষ্ঠ মসৃণ নয়, বরং কিছুটা এবড়োখেবড়ো ও অসমান। এটি এমন একটি পরিবেশে ভালো বেড়ে ওঠে যেখানে বছরে প্রায় ১০০০ থেকে ২০০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয় এবং তাপমাত্রা ২৫ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে। এই গাছটি কিছুটা অম্লাক্ত মাটিতে বেড়ে ওঠে, তাই মাটির অম্লতা গাছটির বৃদ্ধির জন্য উপকারী।
ভেষজ গুণ এবং সমাজে গুরুত্ব
বনবাসী সমাজে এই গাছটির নানা ভেষজ গুণ রয়েছে, যা তাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত, জনজাতি সমাজ এই গাছটিকে তাদের জীবনধারার একটি অপরিহার্য অংশ হিসেবে দেখে, কারণ এটি তাদের খাদ্য, ঔষধ, এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপকরণ সরবরাহ করে। এর কাঠ, পাতা, ফুল এবং ছাল – সবকিছুই তাদের জীবনের সাথে যুক্ত। গাছটি এমন এক প্রাকৃতিক উপাদান, যা বিভিন্ন রোগের প্রতিকার হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং সমাজের জীবনযাত্রায় নানা কাজে আসে। করমপূজা উৎসবে, এই গাছটির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় এবং এই উৎসবের মাধ্যমে প্রকৃতি এবং বন সংরক্ষণের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়। জনজাতি সম্প্রদায়ের মধ্যে এই পূজার মাধ্যমে তাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয়। এর পাশাপাশি, কৃষিকাজে এই গাছটির ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়, কারণ গাছটির উপস্থিতি কৃষির সাথে সম্পর্কিত অনেক সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম।
করমপূজার সামাজিক গুরুত্ব
এই পূজার মাধ্যমে বনবাসী সমাজের মানুষ তাদের সামাজিক বন্ধনকে আরও দৃঢ় করে, এবং বনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করে। এটি একটি ঐতিহ্যবাহী উৎসব, যা সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ঐক্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বনবাসী সমাজের সদস্যরা এই পূজা দিয়ে নিজেদের বংশপরম্পরায় চলে আসা বিশ্বাস ও আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রতি তাদের দায়িত্ব ও ভালোবাসা প্রকাশ করে।
শেষ কথা
করমপূজা শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় বা সামাজিক উৎসব নয়, এটি প্রকৃতি এবং মানুষের সম্পর্কের একটি গভীর প্রতিফলন। এর মাধ্যমে বনবাসী সমাজ তাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে। এই উৎসবটি একদিকে যেমন পরিবেশের গুরুত্ব বোঝায়, তেমনি এটি জনজাতি সমাজের জীবনধারা এবং তাদের ঐতিহ্য সংরক্ষণের একটি চমৎকার উদাহরণ। করমপূজা আজও বনবাসী সমাজের জন্য একটি অনন্য উৎসব হয়ে রয়েছে, যা প্রাকৃতিক ঐতিহ্য, বিশ্বাস এবং সংস্কৃতির এক অতুলনীয় প্রকাশ। এভাবে করমপূজা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ক কখনোই বিচ্ছিন্ন হতে পারে না, বরং তাদের মধ্যে একটি শক্তিশালী বন্ধন গড়ে উঠতে হবে, যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুস্থ এবং সুরক্ষিত পরিবেশ নিশ্চিত করবে। ধর্ম এবং সংকৃতি সম্পর্কিত আরও তথ্য সবার আগে পেতে আমাদের ওয়েবসাইটের অন্যান্য তথ্য পড়ুন। তথ্যসূত্র– ফিউরি।
DISCLAIMER
এই আর্টিকেলে এবং আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে প্রদত্ত তথ্যগুলি বিশ্বাসযোগ্য, যাচাই করা এবং অন্যান্য বিশ্বস্ত মিডিয়া হাউস থেকে নেওয়া হয়েছে তা নিশ্চিত করার জন্য যে আমরা সমস্ত নির্ভুল তথ্য দিয়েছি। কোনো প্রতিক্রিয়া বা অভিযোগের জন্য [email protected] মেইলে আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন।