শবে বরাত বা লাইলাতুন নিসফি শাবান মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি বিশেষ রাত। এই রাতকে কেন্দ্র করে আমাদের সমাজে নানা রকমের আচার-অনুষ্ঠান, ইবাদত-বন্দেগি এবং বিভিন্ন প্রথা প্রচলিত রয়েছে। কিন্তু এই সব কিছুই কি ইসলামী শরিয়াহর আলোকে সঠিক? শবে বরাতের আমল ও ফজিলত সম্পর্কে আমরা কতটা জানি বা আমল করি? প্রশ্ন সেখানে থেকেই যায় যে, এই রাতে কী কী আমল করা উচিত এবং কী কী করা উচিত নয়। আজ আমরা এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো, যাতে আমরা সঠিক পথে চলতে পারি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি।
লাইলাতুন বরাত বা শবে বরাতের ফজিলত
শবে বরাতের রাতটি অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। এই রাতে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের ক্ষমা করেন। হাদিসে বর্ণিত আছে যে, এই রাতে আল্লাহ তাআলা হিংসুক এবং মুশরিক ছাড়া বাকি সব মুসলমানদের ক্ষমা করে দেন। তবে এই রাতের ফজিলতের কথা বলে আমরা যেন কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি বা কুসংস্কারে জড়িয়ে না পড়ি, সেদিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে।
শবে বরাতের আমল: ৬টি আমল ভুলেও ছাড়বেন না
- ঈমান ও তাকওয়া অর্জন করা
শবে বরাতের রাতে প্রথম যে আমলটি করতে হবে, তা হলো ঈমান ও তাকওয়া অর্জন করা। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, “যদি কোনো জনপদের লোকেরা ঈমান আনে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে, তাহলে আমি আসমান থেকে বরকতের সব দুয়ার খুলে দেব।” (সূরা আল-আরাফ, আয়াত ৯৬)। তাই এই রাতে আমাদের উচিত নিজের ঈমানকে মজবুত করা এবং গুনাহ থেকে দূরে থাকার সংকল্প করা। তাকওয়া বা আল্লাহভীতি আমাদের জীবনে বরকত আনে এবং আমাদের রিজিককে প্রশস্ত করে।
- বেশি বেশি ইস্তেগফার করা
দ্বিতীয় আমল হলো বেশি বেশি ইস্তেগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করা। আল্লাহ তাআলা সূরা নূহে বলেছেন, “তোমরা আল্লাহর কাছে ইস্তেগফার করো, নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বৃদ্ধি করবেন এবং তোমাদের জন্য বাগিচা ও নদীনালা প্রবাহিত করবেন।” (সূরা নূহ, আয়াত ১০-১২)। ইস্তেগফার আমাদের গুনাহ মাফ করে এবং আমাদের রিজিকে বরকত আনে। তাই শবে বরাতের রাতে বেশি বেশি ইস্তেগফার করা উচিত।
- শোকর আদায় করা
তৃতীয় আমল হলো শোকর বা কৃতজ্ঞতা আদায় করা। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, “যদি তোমরা শোকর আদায় করো, তাহলে আমি অবশ্যই তোমাদেরকে আরো বেশি দেব।” (সূরা ইবরাহিম, আয়াত ৭)। আমরা যা পেয়েছি, তার জন্য আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা আমাদের কর্তব্য। শোকর আদায়ের মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের নেয়ামত বাড়িয়ে দেন এবং আমাদের জীবনে বরকত দান করেন।
- দান-সাদাকা করা
চতুর্থ আমল হলো দান-সাদাকা করা। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, “আল্লাহ সুদকে ধ্বংস করেন এবং সাদকাকে বৃদ্ধি করেন।” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ২৭৬)। দান-সাদাকা আমাদের সম্পদে বরকত আনে এবং আমাদের গুনাহ মাফ করে। শবে বরাতের রাতে দান-সাদাকা করার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি এবং আমাদের রিজিককে প্রশস্ত করতে পারি।
- আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা
পঞ্চম আমল হলো আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা। নবীজি (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি চায় তার রিজিক ও আয়ুতে বরকত হোক, সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করে।” (বুখারি ও মুসলিম)। আত্মীয়দের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখা আমাদের জীবনে বরকত আনে এবং আমাদের রিজিককে প্রশস্ত করে। তাই শবে বরাতের রাতে আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করা উচিত।
- একত্রিত হয়ে খাবার খাওয়া
ষষ্ঠ আমল হলো একত্রিত হয়ে খাবার খাওয়া। নবীজি (সা.) বলেছেন, “তোমরা একত্রিত হয়ে খাবার খাও, তাহলে আল্লাহ তোমাদের খাবারে বরকত দান করবেন।” (আবু দাউদ)। আমাদের সমাজে এই সুন্নতটি প্রায় হারিয়ে গেছে। আমরা আলাদা আলাদা প্লেটে খাবার খাই, যা আমাদের খাবারে বরকত কমিয়ে দেয়। শবে বরাতের রাতে পরিবার ও আত্মীয়দের সাথে একত্রিত হয়ে খাবার খাওয়ার মাধ্যমে আমরা এই সুন্নতটি পালন করতে পারি এবং আমাদের খাবারে বরকত পেতে পারি।
শবে বরাতে কী কী করা উচিত নয়
শবে বরাতের রাতে কিছু কাজ করা থেকে বিরত থাকা উচিত। যেমন:
১) অতিরিক্ত আলোকসজ্জা: অনেকেই শবে বরাতের রাতে মসজিদ বা বাড়িতে অতিরিক্ত আলোকসজ্জা করেন। এই কাজটি ইসলামে সমর্থিত নয়। আলোকসজ্জা করা যদি সারা বছর না করে শুধু এই রাতেই করা হয়, তাহলে তা একটি বিদআত বা নিষিদ্ধ কাজ হয়ে যায়।
২) পটকা ফোটানো: আগে শবে বরাতের রাতে পটকা ফোটানোর প্রচলন ছিল। কিন্তু এটি একটি কুসংস্কার এবং ইসলামে এর কোনো ভিত্তি নেই। আল্লাহর ইবাদতের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। বরং এটি পরিবেশ ও মানুষের জন্য ক্ষতিকর।
৩) হালুয়া-রুটি খাওয়ার রীতি: অনেকেই মনে করেন যে, শবে বরাতের রাতে হালুয়া-রুটি খাওয়া নবীজি (সা.)-এর সুন্নত। কিন্তু এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। নবীজি (সা.)-এর দাঁত মোবারক শহীদ হওয়ার কারণে তিনি হালুয়া খেয়েছিলেন, এটা তাঁর সুন্নত নয়। তাই এই রীতি পালন করা ঠিক নয়।
৪) মসজিদে জমায়েত হওয়া: শবে বরাতের রাতে মসজিদে বিশেষ দোয়া-দরুদের জন্য জমায়েত হওয়ার প্রচলন আছে। কিন্তু এই রাতকে কেন্দ্র করে মসজিদে বিশেষ জমায়েত হওয়া ইসলামে সমর্থিত নয়। ব্যক্তিগত ইবাদত করা যেতে পারে, কিন্তু জমায়েত করে বিশেষ অনুষ্ঠান করা ঠিক নয়।
শবে বরাতের রাতে আমাদের সমাজে প্রচলিত কিছু ভুল ধারণা
শবে বরাতের রাতে আমাদের সমাজে কিছু ভুল ধারণা এবং কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে। যেমন:
- ভাগ্য নির্ধারণের রাত
অনেকেই মনে করেন যে, শবে বরাতের রাতেই সারা বছরের ভাগ্য নির্ধারিত হয়। তাই এই রাতে বেশি বেশি ইবাদত করলে সারা বছরের ভাগ্য ভালো হবে। কিন্তু এই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। ভাগ্য নির্ধারণের বিষয়টি সম্পূর্ণ আল্লাহর হাতে। আমরা শুধু চেষ্টা করতে পারি, কিন্তু ভাগ্য পরিবর্তন করার ক্ষমতা আমাদের নেই।
- মৃত ব্যক্তির জন্য খানাপিনার আয়োজন
আমাদের সমাজে মৃত ব্যক্তির জন্য চল্লিশা বা জমাত খাওয়ানোর প্রচলন রয়েছে। কিন্তু এই প্রথাটি ইসলামে সমর্থিত নয়। এই প্রথাটি হিন্দু ধর্মের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান থেকে এসেছে। ইসলামে মৃত ব্যক্তির পরিবারকে খাওয়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু মৃত ব্যক্তির জন্য বিশেষ খানাপিনার আয়োজন করা সমর্থিত নয়।
মৃত ব্যক্তির জন্য আমাদের করণীয় হলো দোয়া করা, ইস্তেগফার করা এবং দান-সাদাকা করা। মৃত ব্যক্তির পরিবারকে সাহায্য করা উচিত, কিন্তু তাদের উপর খানাপিনার বোঝা চাপানো উচিত নয়।
উপসংহার
শবে বরাতের রাতটি অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। এই রাতে আমরা বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগি করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারি। কিন্তু এই রাতকে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি বা কুসংস্কারে জড়ানো উচিত নয়। আমরা এই আর্টিকেল দ্বারা চেষ্টা করেছি শবে বরাতের আমল ও ফজিলত সম্পর্কে সচেতন করতে।
আমাদের উচিত ইসলামের সঠিক পথে চলা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করা। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সঠিক পথে চলার তৌফিক দান করুন এবং আমাদের সমাজ থেকে সব ধরনের কুসংস্কার ও বিদআত দূর করুন। আমিন।